January 17, 2025, 1:51 pm
পাকিস্তান সৃষ্টির পর সরকার যখন চাইল উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা তখন পূর্ব বাংলার জনগণ দাবি তুলল উর্দুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক। এটি সরাসরি নাকচ করল পাকিস্তান সরকার। তখন পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতা ও বুদ্ধিজীবীগণ দাবি তুললেন দুটি- (এক) পূর্ব-পাকিস্তানে শিক্ষার মাধ্যম ও সরকারি দাপ্তরিক কাজের মাধ্যম হতে হবে বাংলা এবং (দুই) কেন্দ্রীয় সরকারি দাপ্তরিক কাজে রাষ্ট্রভাষা হতে হবে দুটি বাংলা ও উর্দু। এ দুই দাবির পক্ষে আবুল কাশেমের নেতৃত্বে প্রথম আন্দোলন গড়ে তোলে ‘তমুদ্দুন মজলিশ’ নামক সংগঠন।
চল্লিশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে ‘পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগ’ গঠনের কাজে ব্যস্ত তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তখন চাচ্ছিলেন বাংলা ভাষা একটি যথাযথ ও মর্যাদাপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত হোক। ৫ ডিসেম্বর ১৯৪৭ বাংলা ভাষার দাবিতে শেখ মুজিবসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে একটি মিছিল পূর্ব পাকিস্তান মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ‘বর্ধমান হাউসে’ (বর্তমান বাংলা একাডেমি) গিয়ে একটি সভায় যোগদান করে।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট ‘গণপরিষদে’ সংসদ সদস্যদের কেবল উর্দু ও ইংরেজিতে বক্তব্য দেওয়ার আহ্বান জানানো হলে কুমিল্লার সন্তান ও কংগ্রেস থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে সাহসের সঙ্গে এ প্রস্তাবের সংশোধনী এনে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানান। সঙ্গে সঙ্গে পাক প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ও পূর্ব-পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন দৃঢ়ভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেন।
এ সংবাদ পূর্ব পাকিস্তানে পৌঁছলে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নগরব্যাপী মিছিল হয়। ১১ মার্চ ১৯৪৮ ঢাকায় তিনটি পয়েন্টের প্রতিবাদে ধর্মঘট পালিত হয়- (এক) গণপরিষদের ভাষার তালিকা থেকে বাংলা ভাষা বাদ দেওয়া, (দুই) পাকিস্তানের মুদ্রা ও ডাকটিকিটে বাংলা ব্যবহার না করা এবং (তিন) নৌবাহিনীর চাকরির পরীক্ষায় বাংলা বাদ দিয়ে শুধু উর্দুকে মাধ্যম হিসেবে রাখা। ছাত্ররা মিছিলে স্লোগান তোলে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।
অনেকের সঙ্গে গ্রেপ্তার হন শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব, শামসুল হক, ওলী আহাদ ও শেখ মুজিবুর রহমান। ১৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৫ মার্চ সারা পূর্ব বাংলায় ধর্মঘট পালিত হলে সেদিনই পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ‘এগ্রিমেন্টে’ স্বাক্ষর করে মেনে নেন যে, বাংলাকে এ প্রদেশের সরকারি ভাষা করা হবে। সেদিনই রাতে আন্দোলনের প্রেক্ষিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয় সরকার। এরপর বহু আন্দোলন-সংগ্রাম।
এই যে বাঙালি জাতির সূর্য সন্তানরা মাতৃভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন করলেন, জীবন দিলেন এর পক্ষে কি কোনো আইনগত যুক্তি ছিল? হ্যাঁ, ছিল। প্রথমত- ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের রাষ্ট্রক্ষমতা’ নীতিটি সকল গণতান্ত্রিক সংবিধানে স্বীকৃত এবং সারাবিশ্বে প্রতিষ্ঠিত। ১৯৩৫ সালের যে ভারত সরকার আইন (Government of India Act) মোতাবেক তখন ভারত ও পাকিস্তান পরিচালিত হচ্ছিল তাতে নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্ধারণের বিধান ছিল অর্থাৎ গণতন্ত্রের বিধান ছিল। সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন হেতু পাকিস্তানের ৫৬% লোকের বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনের অর্থ হলো- একটি গণতান্ত্রিক ও আইনি বিধানের বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন।
বাঙালি জনগোষ্ঠী এ আন্দোলন করে ১৯৪৭ সাল থেকে। এরই আলোকে বাংলাদেশে বর্তমানে কার্যকর ১৯৭২ সালের সংবিধানের তথা সর্বোচ্চ আইনের ২৩ অনুচ্ছেদে বিধান রয়েছে যে, রাষ্ট্র জাতীয় ভাষার পরিপোষণ ও উন্নয়নের এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে যাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখা ও অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়। বলাবাহুল্য, এ সংবিধান ছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত এবং তাঁর মেধা ও মননপ্রসূত।
দ্বিতীয়ত- ‘জনগোষ্ঠীর আত্মনির্ধারণ অধিকার’ একটি মানবাধিকার হিসেবে অন্তর্জাতিক আইনি দলিলে ১৯৬০ সালে স্বীকৃতি পেলেও তা তৎপূর্বের কয়েক দশকে সারাবিশ্বে অধিকার অর্জনের মতো পূর্ণতা ও পক্বতা (maturity) অর্জন করেছিল। দলিলটি হলো ‘কলোনিভুক্ত দেশ ও জনগোষ্ঠীসমূহকে স্বাধীনতা প্রদান ঘোষণা’ [Declaration on the Granting of Independence to Colonial Countries and Peoples (DGICCP)]। এ আইনি দলিল মোতাবেক কোনো ভাষাভিত্তিক সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী আত্মনির্ধারণ অধিকার চর্চার যোগ্য।
তাই যখন দেখা যায় যে, হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বিকশিত ‘বাঙালি জাতি’ বা ‘বাঙালি জনগোষ্ঠী’ ১৯৪৭-এর পর বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয় চেতনাকে শক্তিমান করা ও বাঙালি জাতীয় স্পৃহা তৈরির মাধ্যমে ‘আত্মনির্ধারণ অধিকার’ চর্চার দিকে তথা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দিকে ধাবমান, তখন এটিও নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক আইনের চাদরে আবৃত একটি বিধান।
বস্তুত, ১৯৪৭ সালে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন থেকেই ১৯৭১ সালে আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, যার সূচনালগ্ন থেকে পরিপূর্ণতা অর্জন পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে স্বর্ণলতার মতো জড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মহান চিন্তা, কর্ম, ত্যাগ ও সংগ্রাম। এ কারণেই তিনি আমাদের ‘জাতির পিতা’, ‘বাঙালি জাতির পিতা’।
লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ও কেন্দ্রীয় আইন বিষয়ক সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু পরিষদ
Leave a Reply