1. domhostregbd@gmail.com : devteam :

January 17, 2025, 2:06 pm

সমিরনের দিনকাল – আফরোজা অদিতি

সমিরনের দিনকাল – আফরোজা অদিতি

কলু পাড়ার একটি বাড়ি। বাড়ি ঠিক নয়। ছনে ছাওয়া একটি ঘর। তারও আবার এখানে ওখানে ফাঁকা। সেই ঘরে টিমটিম জ্বলছে কুপিবাতি। সেখানে ঘুমিয়ে সমিরনের শ্বশুর-শাশুড়ি, ছেলেমেয়ে। আর রসুনের ছিলকার মতো ধবধবে জোছনায় ঘানি ঘোরায় সমিরন। তেলের ঘানি ঘোরাতে ঘোরাতে রোজকার মতো আজও মাঝরাত হয় সমিরনের। উঠানে দাঁড়িয়ে আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মোছে। ঘাম মুছতে গিয়ে পরনের শাড়ির শতচ্ছিন্নতার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। একটা শাড়ি কেনা খুব দরকার। শাড়ি কিনবে সমিরন! খাওয়ার টাকা যোগাড় করতেই হিমশিম খায়। তাছাড়া যে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই তারও চাল এবার ছাইতে হবে তা না হলে আগামী বর্ষায় থাকা যাবে না এই ঘরে। এ-ছাড়াও শাশুড়ির বাতের ব্যথা, নড়তে পারে না মালিশ ছাড়া। তাঁর মালিশের ওষুধ কিনতে হবে। শ্বশুর অন্ধ। তাঁর আবার কয়েকদিন জ্বর। ডাক্তার ডাকবে সেই পয়সাও নেই।

                সমিরনের স্বামী, সমির আলী আজ একমাস বাড়ি ছাড়া। কোথায় যে গেছে তার হদিস নেই। বাবা, মা, পোলাপান একজনের, আর দায় টানে  আর একজন। জাতে কলু সমির আলী কিন্তু বাবুয়ানায় সাহেবদেরও ছাড়িয়ে যায়। সংসারে নুন  আনতে  পানতা ফুরায় সেদিকে সমির আলীর দৃষ্টি নেই দৃষ্টি শুধু সমিরনের  টাকা। সমিরনের কাছে টাকা থাকলেই সেটা তাকে নিতেই হবে। তাছাড়া ঘরের বাসনকোসন কিছুই থাকে না, সব সমির আলী বেচে দেয়। টাকা না দিলে,বাসনকোশন বেচতে না দিলে ঝগড়া, তারপর গায়ে হাত। এতো কিছুর মধ্যেও সমিরন সচেষ্ট এই সংসারের চাকাটাকে সচল রাখতে। সংসারের কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে উঠানের এককোণে বেগুন, মরিচ, লাউ-এর গাছ লাগিয়েছে। তাতে যা সব্জি হয় সেগুলো কিছু খায় কিছু  বিক্রি করে।  মুরগিও পোষে। এই ডিম আর সব্জি বিক্রির পয়সা জমা করেছে ঘরে ছন দেবে বলে। এতোদিন সমির আলী বাড়ি থাকলে এ টাকাও থাকতো না ।

                সমিরন কলু বাড়ির মেয়ে নয়। গৃহস্থবাড়ির মেয়ে সমিরন ছোটবেলায় দেখেছে ওদের আঙিনায় সবুজ সবুজ শাক-সব্জির বাগান। মাকে দেখেছে উদায়াস্ত পরিশ্রম করতে। বাবা ছিলেন হাসিতে খুশিতে ভালোবাসায় প্রাণবন্ত মানুষ। বাবা লাঙল দিতো যখন জমিতে তখন বারো বছরের সমিরনের মাথায় ওর মা গামছায় ভাত বেঁধে আর পানির একটা জগ হাতে ধরিয়ে দিতো। সমিরন ওর অতীতে ফিরে যায়।

                “তোর আশায় পথ চায়া আছিরে মা। খিদায় পেটে ছুচার কেত্তন চলতেছেরে মা।” বাবার কথায় বলতো, “এই যে বাজান, লও দেরি হয়া গ্যাছে।”  সমিরনের বাবা খেতো ভাত আর সমিরন ক্ষেতের আইলে একটা তালগাছে বাঁধা বাবুইপাখির বাসার দোল খাওয়া দেখতো। ওর বাবা মাঝে মাঝে দু’এক লোকমা ভাত ওর মুখে তুলে দিতো। খুব মজা লাগতো সেই ভাত মাখানো। কোথায় গেলো সেই দিন। কোথায় রইলো সমিরন আর কোথায় বাবা-মা।

                চারদিকে ফুটফুটে জোছনা। সমিরনের বুকের ভেতর কেমন যেন একটা করে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে চিবুক বেয়ে পড়ে বুকের আঁচলে। আজ খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছে ওর। চোখের পানিতে বাবার আদর মায়ের সোহাগ মনে  ভেসে ওঠে।  “কই-রে বউ কি করতাছস?” ঘরের ভেতর থেকে শাশুড়ির ডাক ভেসে আসে। “শুইবি না? কতো রাইত হইলো। রাইত ভর কেবল বাইরে থাকস। একটুও তো যত্ন আত্তি পাই  না। বাতের ব্যথায় উঠতে পারি না তাই এতো হেনস্থা।” শাশুড়ি গজর গজর করতে থাকে। কিন্তু সমিরনের আজকে জবাব দিতে ইচ্ছা করে না। সমিরন জবাব দেয় না। ঘরেও যায় না।

                মাঝে মাঝে সমিরনের মনের মধ্যে উড়ির চরের ঝড়ের মতো তান্ডব চলতে থাকে। ইচ্ছা করে সব ভেঙেচুরে সাফ করে দিতে, খোদাকে গাল মন্দ দিতে ইচ্ছা করে। আল্লাহ ওরে নিয়ে আর কতো খেলা খেলবে ওর জানতে ইচ্ছা করে। ওর ভাগ্য ঘুরতে ঘুরতে কলুর ঘানির সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে। তাও সহ্য করেছিল। এতো কষ্ট সহ্য করা যায় যদি তার পরিবর্তে বাড়ির লোকের মুখে ভালো কথা শুনতে পায়। ভালো কথা কোনোদিন বলবে না ওরা।

ছয়  বছর ওর বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর থেকে দুই বেলা পেট ভরে ভাত খেতে পায়নি। কাপড় দু’খানা আসেনি। ঘানি ঘোরায় নিজে। ও নিজেই কলুর বলদ। সমিরন চুপচাপ দাওয়ায় বসে থাকে। ওর স্বামী একমাস বাড়ি আসে না। খারাপ হোক ভালো হোক সেই তো স্বামী। ছোটো বেলায় ইমাম সাহেবের কাছে শুনেছে স্বামীর পায়ের তলায় বেহেশত। স্বামীকে যত্ন করতে হয়। তাই তো স্বামী বলে কথা। কিন্তু এমন স্বামীরে তো সমিরনের যত্ন করতে ইচ্ছা করে না। ওর স্বামী ওকে খেতে দিতে পারে না। কাপড় ওষুধ দিতে পারে না, তার ওপর স্বভাব চরিত্র ভালো নয়। কথায় কথায় মারধোর বকাবকি  তো আছেই। সব চেয়ে বড়ো কথা সমিরনকে ওর স্বামী  মিথ্যে কথা বলে বিয়ে করেছে।

                বন্যার সময় সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে যখন আশ্রয় নেয় ওরা। তখন সমিরনের মা বন্যায় জলের তোড়ে কোথায় ভেসে গেছে জানা যায়নি।  ছোটো ভাইটাও মায়ের সঙ্গেই  ভেসে গেছে। ও আর ওর বাবা আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় পেয়েছে । বাবার জ্বর। সেই সময় একদিন।

“ও চাচা মিঞা?”

“তুমি কেডা বাবা?”

“আমাদের চিনবেন না। ওই পাশের গ্রামে বাড়ি। এই আশ্রয় কেন্দ্রের দেখাশুনা করি। তা আপনের শরীরডা নাকি খারাপ। সাথে কেডা আছে চাচা মিঞা?”

“একটু খারাপ” কথা বলেই কাশতে থাকে। নব পরিচিত সমির আলী খুব ব্যস্ত হয়ে ওষুধপথ্য যোগাড় করে আনে।

                একদিন দুইদিন যায় জ্বর ছাড়ে না। সমীর আলীও  যায় না। দেখতে শুনতে ভালো, ফর্সা মুখে বড়ো বড়ো টানা টানা চোখ আর একপিঠ ছড়ানো কালো চুলের সমিরনকে দেখে সমির আলীর মনে তৃষ্ণা জাগে তা বুঝতে পারেনি ওরা। বাবাও না, সমিরন নিজেও না। সে সময় এসব বুঝার বয়সও হয়নি ওর। সমিরন ভাবে “কপালের লিখন না যায় খণ্ডন”। তা না হলে বাবার অসুখই বা হবে কেন আর এই লোকের সঙ্গে দেখাই বা হবে কেন! বাবার অসুখ বাড়াবাড়ির সময় ওই লোক বিয়ের প্রস্তাব দেয় আর সমিরনের বাবাও রাজি হয়ে যায়। সমির আলীর প্রথম পক্ষের বউ ছেলেমেয়ে আছে তা ওরা জানতো না। সমির আলী বলেছে ওর অবস্থা এমন কিছু নয় তবে একটা তেল ভাঙানো কল আছে। মৃত্যুর সময়ে এমন প্রস্তাব লোভনীয়।

                সেই যে ছয় বছর আগে সমিরন এই বাড়িতে এসে ঢুকেছে আর বের হয়নি। বাবার মৃত্যুসংবাদ পেয়েছে বিয়ের দুই দিন পর, যায়নি, যেতে পারেনি।  একা পথ চেনে না কেমন করে যাবে ? সমির আলী নিয়ে যায়নি।

                চারদিকে খাঁখাঁ জোছনায় সমিরনের মনের ভেতরটা আজ শূন্য মনে হয়। ঘরের দাওয়ায় জল থাকে। ঢকঢক করে

গলায় ঢালে। লোকটা আজও এলো না। কি জানি আবার কোন মেয়ের সর্বনাশে ব্যস্ত। দূরে কোথায় একটা পেঁচার ডাক শোনা যায়। পেঁচার ডাকে সমিরন কোনো দিন ভয় পায় না তবে আজ কেমন চমকে ওঠে। সমির আলীর কথা চিন্তা করে। চিন্তা করে  নিজের কথাও। কে আছে ওর? কোথায় যাবে ও? যদিও যাওয়ার জায়গা নেই। তবুও আর সহ্য করবে না সমিরন। কোন বিচার? স্বামী খেতে দেবে না, পরতে দেবে না অথচ স্বামীকে যত্ন করতে হবে ; তাঁর পরিবারের জন্য নিজের সমস্ত জীবন-যৌবন-ভালোলাগা-ভালবাসা সব বিলিয়ে দিতে হবে। সে কাজ করে মরবে আর বাবুয়ানা করবেন উনি আর বাড়ির লোক না খেয়ে থাকবে। তা হবে না। নিজের মনে একা একা কথা বলে সমিরন ।

“কার সাথে কথা কসরে বউ?”

সমিরন এবার রাগ করেই বলে, “কারো সঙ্গেই না, আপনে ঘুমান।”

                ঝলমলে জোছনা নিভে যায় একসময়। সমিরন বসে থাকে। সারাদিনের খাটুনি শেষে বসে থাকতে থাকতে এক সময় ঝিমুনি এসেছিল। বাঁশের খুঁটির সঙ্গে হেলান দিয়ে ঝিমায়। কতোক্ষণ এভাবে ছিল জানে না। উঠানে পায়ের শব্দ। সমিরন তাকায়। জোছনা নিভে গেছে। পাখি ডাকা ভোর। সামনে সমির আলী আর তার পেছনে লাল শাড়ীতে ঢাকা  নববধূ।

সমিরনের দু’চোখে জ্বলে ওঠে আগুন। সে পথ আগলে দাঁড়িয়ে থাকে।    

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © 2022 duibangla.com
Developed by duibangla.com Team